স্কুল আমাদের সৃজনশীলতা নষ্ট করে দিচ্ছে! 😑

 বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে অনেক কথাই তো আমরা শুনি। সরকারি প্রটোকলের বাইরে থাকা প্রায় সব লোক-ই বলে - "এই শিক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে দ্রুতি পরিবর্তনশীল বিশ্বের সাথে তাল মিলানো সম্ভব না।" কেউ আবার বলে - "দেশে শিক্ষা আছে তাই কত"। শত শত কথা নানান লোকে নানান কায়দায় বলে। তবে কেউ কখনো কোনো স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের কাছে শুনতে যায় না যে - "কী ভাতিজা! এডুকেশন সিস্টেমে মানায় নিতে কোনো সমস্যা হচ্ছে নাকি?" বা "তোমাদের জন্যই তো সব। কোন ভাবে করলে ভালো হবে বলো তো?" না এভাবে আমাদের কাছে কেউ শুনতে আসবে না। অনেকে এখন কমেন্ট বক্সে এসে বলবেন - "হ! এমন করে জিজ্ঞেস করলে সব ছাত্র-ছাত্রী বলবে, স্কুল-বন্ধ করে দাও। আমাদের পড়ালেখার কোনো প্রয়োজন নেই।" কথা কিন্তু সত্য। আমরা এমনি বলবো। তবে এই লিখাতে আমি আপনাদেরকে এটিও বলবো যে- কেন আমরা এটা বলবো? 



১। সময় যে বড় অল্প

আমাদের-কে (মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে) দিনে ৬ ঘন্টা (সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা) স্কুলে থাকতে হয়। যাওয়া আসার সময় মিলিয়ে আরো ১ ঘন্টা, মোট (৬+১) = ৭ ঘন্টা। ধরুন দিনের তিন ভাগের একভাগ সময় দিতে হয় স্কুলের পিছনে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের উন্নত-অনুন্নত প্রায় সবদেশের চিত্র-ই এক। চোখে পড়ার মতো কোনো পার্থক্য আপনি পাবেন না। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অন্য আরো বড় একটা সময়সাপেক্ষ কাজ  রয়েছে  - কোচিং , হোম-টিউটর, প্রাইভেট, অনলাইন ভাইয়াদের ক্লাস ইত্যাদি (এসবের সাথে যারা জড়িত তারা পুরাটা না পড়ে গালাগালি করবেন না, প্লিজ!) 

যে ছেলে/মেয়েটা ক্লাস 8,9 কিংবা 10 পড়ে, তাকে কম করে হলেও দিনে দুইটা - কোচিং , হোম-টিউটর, প্রাইভেট ইত্যাদির মধ্য দিয়ে যেতে হয় (শহরাঞ্চলের কথা বললাম)। গ্রামের ক্ষেত্রেও একটা তো দেখা দিবেই। এগুলো ধরুন আরো ২ থেকে ৩ ঘন্টা সময় নেয়। মোট (৭+৩) = ১০ ঘন্টা। একজন কিশোর/কিশোরীর দিনে কম করে হলেও ৬ ঘন্টা ঘুমানো উচিৎ। প্রতিদিনের বেসিক দৈনন্দিন কাজগুলোতে যেমন খাওয়া, গোসল, মল-মূত্র ত্যাগ ইত্যাদিতে মোটামুটি ২.৫ থেকে ৩ ঘণ্টা ব্যয় হয়। মোট (১০+৬+২.৫)= ১৮.৫ ঘন্টা। 

আরে ভাই আরো বাকি আছে! এই স্কুল-কলেজ আর হোম-টিউটররা আমাদেরকে বাড়ির কাজও দেয় কিন্তু। সেগুলোও করতে হয়। দিনে সময় বাকি আছে (২৪ - ১৮.৫) = ৫.৫ ঘন্টা। স্কুলে প্রতিদিন ক্লাস হয় গড়ে ৬ থেকে ৭ টি  + কিছু না হলেও গনিত প্রাইভেট। মোট ধরলাম এই ৮টি সাব্জেক্টের মধ্যে - গনিত, ইংরেজি, বিজ্ঞান, বাংলা ব্যকরণ,  হোম-টিউটর, গ্রুপ ভিত্তিক কোনো একটি সাব্জেক্টের শিক্ষকরা তো বাড়ির কাজ দিতে মিস ভুলেও করবেন না। এবার বলুন ৫.৫ ঘন্টায় ছয়টি সাব্জেক্ট আমাদেরকে পড়তে হয়। (যদিও সব গুলো পড়া সম্ভব নয়, দুই একজন ক্লাস টপারের কথা বাদ দিন) । 

তাহলে নিজের জন্য সময় থাকলো - টা কী? না বিশ্রাম, না খেলাধুলা, না সামান্য ফ্রি হান্ড-এক্সারসাইজ কিংবা টিভি/ইউটিউব। আমরা কি নিজের জন্য সময় একটুখানি সময় পাবো না। 

 

এখন যেসকল মুরুব্বিরা কমেন্টে লিখতে যাচ্ছেন যে - "তোমারা সারাদিন কি করো তা তো বুঝি আমরা জানি না। পড়ালেখা বাদে সবই করো।" তা মুরুব্বি আপনি ভুল কিছু বলছেন না। আপনি প্রতি ১০০ জনের মাত্র ৭ থেকে ৮ জন- কে আমার উল্লেখ করা রুটিন অনুসারে দিন কাটাতে দেখবেন (শহর এলাকায় ৫০ থেকে ৭০ জন, তবে সারাদেশের গড় করলে ১০% উপরে উঠবে বলে মনে হয় না)।


২। বন্ধ করে দাও  - কোচিং , হোম-টিউটর, প্রাইভেট......

বাংলাদেশ সরকার এই প্যাঁচাল বহু আগে থেকেই আমাদেরকে শুনাচ্ছে। কোচিং , হোম-টিউটর, প্রাইভেট এগুলো বন্ধ করলে আমরা দিনে বাড়তি ৩ ঘন্টা সময় পাবো ঠিক-ই, তবে আমরা কিছুই শিখবো না। কিচ্ছু না। 

আমি যদি আমার কথা বলি তাহলে - আমি এই ক্লাস ১০ পর্যন্ত যা শিখেছি, তার ৯০% -ই শিখেছি কোচিং , হোম-টিউটর, প্রাইভেট আর অনলাইন ভাইয়াদের মাধ্যমে। স্কুলকে বাকি ১০% দিতেও আমার কুন্ঠা বোধ হয়। আসলেই কি এই ১০% দেওয়া যায়। 




৩। তাহলে স্কুলে কি ঘাস কাটো তোমরা?

স্কুলের শিক্ষকরা শেখান না বা শেখাতে পারেন না এমন কোনো কথা আমি বলছি না। স্কুলের মূল সমস্যা হলো যথাযথ ম্যানেজমেন্টের অভাব। ছয় ঘন্টার মধ্যে - 
  1. সমাবেশ করাও,
  2. ৮ টা ক্লাস নাও,
  3. টিফিন দাও,
  4. একজন শিক্ষকের উপর ১০০জন টিনএজার(Teenager) কে ছেড়ে দাও,
ভাইরে ভাই! আপনিই বলুন, আপনি স্কুলে গনিত পড়ান। আপনাকে ৪০ মিনিট সময় দিয়ে বলা হলো, ক্লাসে গিয়ে -- 
  • ৭০ জন শিক্ষার্থীর নামে ডাকবেন, 
  • ৭০ জনের ৫০ জন-ই দুষ্টু টিনএজার, তাদেরকে শান্ত করবেন
  • দুইটা অংক বুঝাবেন,
  • দূর্বল শিক্ষার্থীকে এক্সট্রা সাপোর্ট দিবেন.........
আপনি পারবেন তো?  দুইটা করে অংক বুঝিয়ে সিলেবাস শেষ হবে তো? 

আরো আছে- আমাদের কিছু শিক্ষককে দিনে ৫টা থেকে এমনি ৭-৮ টা ক্লাস পর্যন্ত নিতে হয়। অনেক সময় টানা কথা বলে যেতে হয়, তাও আবার এক পাল দুষ্টু কিশোর-কিশোরীর মাঝে। এত কিছুর পর সেই শিক্ষক মাস শেষে বেতন পান মাত্র ১৮ থেকে ২৫ হাজার টাকা (আধা-সরকারী ও বেসরকারি স্কুলের ক্ষেত্রে)। আচ্ছা, সেই শিক্ষক যদি প্রাইভেট পড়িয়ে বাড়তি ৭-৮ হাজার টাকা আয়ের চেষ্টা করেন তাহলে আমি তার এই চেষ্টায় কোনো দোষ দেখি না। এমনিতেও ৬০-৭০ জনের হাউ-কাউয়ের মাঝে আমাদের পক্ষে মাত্র ৪০ মিনিটে কিছু বোঝা সম্ভব হয় না। বিশ্বাস না করলে একদিন বসে আমাদের সাথে ক্লাস করে দেখুন। 




৪। স্কুল আমাদের সৃজনশীলতা নষ্ট করে দিচ্ছে! 😑

সময়ের হিসাব আগেই দিয়েছি। আমাদের নিজের মতো করে কাটানোর কোনো সময় নেই। বাড়তি কিছু চিন্তা করার কোনো প্রশ্নই আসে না। শিক্ষা ব্যবস্থায় নাম মাত্র সৃজনশীলতার বুলি আওরানো হয়। আমাদের দেশের সরকারি পর্যায়ের শিক্ষাবিদরা যদি সত্য কথা বলতেন, তাহলে বাজারে এতো এতো গাইড, সাপ্লিমেন্ট বা সহায়িকা বইয়ের ছড়াছড়ি দেখা যেত না। এককথায় নামে সৃজনশীল আর কাজে মুখস্ত বিদ্যা। 

উপরের লিখাতে বলেছি, আমাদের সবচেয়ে বেশি সময় নষ্ট হয় স্কুলে। স্কুলে যাই শুধু মাত্র এই কারণে যে, সেখানে উপস্থিতির উপর নম্বর দেওয়া হয়। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্ট পরিমাণ উপস্থিতি না থাকলে পরীক্ষা দিতে দেওয়া হয় না। - it obviously a bad system.

 যেখানে পাঠ্যপুস্তক গুলো আমাদের শেখায় - মুখস্ত করতে। বইগুলো চীৎকার করে বলে - "সাপ্লিমেন্ট ছাড়া শুধু আমাকে পড়ে কোনো লাভ হবে না।" (বিশ্বাস না হলে,নবম- দশম শ্রেণির পদার্থ বিজ্ঞান বইটা পড়ার পর একটা প্রশ্ন পত্র হাতে নিয়ে দেখেন) 

স্কুল আমাদেরকে এই দূর্বল, ব্যাকডেটেড, মুখস্ত নির্ভর বইগুলোও পড়াতে ব্যর্থ হয়, কিন্তু ঠিকই দিন থেকে ছয় ঘন্টা সময় কেড়ে নেয়। সেখানে কে সৃজনশীল হবে? পরিবার শুধু জিপিএ ৫ পেলেই খুশি। সেখানে একজন সৃজনশীল মানুষ হওয়া বড়ই কঠিন।

সমাধানঃ

  • স্কুলে ছয় ঘন্টায় ৭-৮ টা ক্লাস না নিয়ে, ৩-৪ থেকে চারটি ক্লাসে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া।
  • শিক্ষকদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। প্রতি ২০-৩০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক হলে ভালো হয়, যেমনটি ইউরোপের দেশগুলোতে দেখা যায়।
  • বইগুলোকে আপডেট করতে হবে, প্রতিবছর নতুন করে বইইয়ের কন্টেন্ট না সাজালে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পরবে।
  • পরিবার ও সমাজকে বুঝতে হবে, একটা শিক্ষাব্যস্থা দিয়ে কখনো-ই একজন মানুষের সক্ষমতা বিচার করা যায় না। 
  • পরীক্ষায় খয়রাতি নম্বর দেওয়া বন্ধ করতে হবে। (রিডিং পড়তে না পারা পোলাপাইনে কেমনে পাস করে আমি এখনো বুঝি নাই ভাই!) 
  • শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি করতে হবে। (নিজের সন্তানকে ভাত দিতে না পারলে, পরের সন্তানকে জ্ঞান দেওয়া সম্ভব না - প্রতীকী অর্থে বললাম)
আমি কোনো শিক্ষাবিদ নই। একজন শিক্ষার্থী , ভুল থাকতেই পারে। শুধুমাত্র যা দেখছি, যা বুঝেছি, তাই লিখলাম।







About the author

MD Zakaria Hossen
Hi! I am Zakaria. I am the founder of Kochu Programmer. I want to spread tech knowledge to everyone.

إرسال تعليق