জুলাই বিপ্লব: তারুণ্যের জাগরণ


জুলাই বিপ্লব: তারুণ্যের জাগরণ



ভূমিকা

জুলাই ২০২৪ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে, যেখানে তরুণেরা জেগে উঠে দেশের অবিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে। ‘জুলাই বিপ্লব’ কেবল কোটা সংস্কারের আন্দোলন নয়, এটি ছিল একটি জনস্রোতের উন্মেষ, যা সমাজের পুরনো অবকাঠামোকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নতুন রাজনৈতিক জাগরণের বার্তা নিয়ে এসেছিল। এই রচনায় আমরা বিশ্লেষণ করবো কীভাবে এই বিপ্লব সমাজ, রাজনীতি ও ভবিষ্যতের পথে প্রভাব ফেলল।


প্রেক্ষাপট ও কারণ

বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্কিত একটি ইস্যু। বিশেষ করে ২০১৮ সালে ছাত্রদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনের পর বিষয়টি নতুনভাবে আলোচনায় আসে। তখন সরকার কোটা বাতিলের ঘোষণা দিলেও, ২০২৪ সালের মাঝামাঝি হাইকোর্টের রায়ে আবার ৩০% কোটা পুনর্বহাল করা হয়। এই সিদ্ধান্ত তরুণদের মধ্যে হতাশা, ক্ষোভ এবং অসন্তোষের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। তারা মনে করে, এই ব্যবস্থায় মেধার মূল্যায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং প্রতিযোগিতামূলক চাকরির বাজারে যোগ্য প্রার্থীরা পিছিয়ে পড়ছে।

শুধু কোটা নয়, এর পেছনে ছিল আরও গভীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসন্তোষ। তরুণদের উচ্চ বেকারত্ব, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব, শিক্ষার মান ও চাকরির সীমিত সুযোগ—সব মিলিয়ে দেশের শিক্ষিত প্রজন্ম মনে করছিল তারা একটি অসাম্যভিত্তিক সমাজে বসবাস করছে। এছাড়া রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে দুর্নীতি, পক্ষপাত ও জবাবদিহির অভাব তরুণদের মধ্যে হতাশা বাড়িয়ে তোলে।

এই প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালের জুন-জুলাইয়ে ছাত্র ও তরুণ সমাজ রাজপথে নেমে আসে। তারা কেবল চাকরি নয়, বরং সমতার সমাজ, মেধার মর্যাদা এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার দাবি তোলে। আন্দোলনটি ধীরে ধীরে দেশের নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শহর এবং অনলাইন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তরুণদের ক্ষোভ আর প্রত্যাশা মিলে গড়ে উঠে ‘জুলাই বিপ্লব’—যা হয়ে ওঠে এক নতুন প্রজন্মের প্রতিবাদ আর জাগরণের প্রতীক।


আন্দোলনের দাবি ও নেতৃত্ব

জুলাই বিপ্লবের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল কোটা সংস্কার, কিন্তু এটি শুধুমাত্র একটি প্রশাসনিক ইস্যুতে সীমাবদ্ধ ছিল না। আন্দোলনকারীরা দ্রুত তাদের দাবিকে ছড়িয়ে দেন একটি বৃহৎ ন্যায়ের প্রশ্নে। তারা চেয়েছিল একটি স্বচ্ছ, মেধাভিত্তিক, পক্ষপাতহীন নিয়োগ ব্যবস্থা, যেখানে কেউ জন্ম পরিচয়ের ভিত্তিতে বাড়তি সুবিধা পাবে না। মূল দাবি ছিল:

  1. মেধাভিত্তিক নিয়োগের নিশ্চয়তা (৯৩% নিয়োগ মুক্ত প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে)

  2. বিকল্পভাবে ৭% সুনির্দিষ্ট ও যৌক্তিক কোটা চালু করা

  3. আন্দোলনের সময় নিহত ও আহতদের জন্য বিচার ও ক্ষতিপূরণ

  4. আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হয়রানি বন্ধ

  5. ইন্টারনেট ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার

  6. বিচার বিভাগ ও প্রশাসনে স্বচ্ছতা আনার আহ্বান

এই দাবিগুলো প্রমাণ করে যে, এটি কেবল চাকরি প্রাপ্তির লড়াই নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ সামাজিক-রাজনৈতিক সংস্কারের ডাক।

আন্দোলনের নেতৃত্ব গড়ে ওঠে মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রদের মধ্য থেকে। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে একটি সংগঠন মূল ভূমিকা পালন করে। এই নেতৃত্ব ছিল অনানুষ্ঠানিক, কেন্দ্রহীন এবং ফ্ল্যাট হায়ারার্কিতে পরিচালিত—তাতে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে মেসেজ ছড়িয়ে আন্দোলনকে দ্রুত গতি দেওয়া সম্ভব হয়।

তরুণরা আন্দোলনের ব্যানারে কেবল রাজনৈতিক স্লোগান দেয়নি, তারা গান, কবিতা, রঙিন ব্যানার, পোস্টার এবং ‘বাংলা ব্লকেড’–এর মতো সৃজনশীল পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রতিবাদকে এক সাংস্কৃতিক উৎসবে রূপ দেয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি তরুণ প্রজন্মের এক নতুন রাজনীতি চর্চার সূচনা করে, যেখানে পরিবর্তনের ভাষা হয়ে উঠে মেধা, শিল্প, এবং প্রযুক্তি


প্রধান ঘটনাচক্র

১ জুলাই ২০২৪, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে শিক্ষার্থীদের এক শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচির মাধ্যমে ‘জুলাই বিপ্লব’ শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে এটি ছিল সরকারি চাকরিতে পুনর্বহাল হওয়া ৩০% কোটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কিন্তু খুব দ্রুতই এই আন্দোলন দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, এমনকি বিভিন্ন জেলার তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।

৭ জুলাই থেকে ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে এক ব্যতিক্রমধর্মী কর্মসূচি চালু হয়। শিক্ষার্থীরা শুধু ক্লাস বর্জন করেই নয়, বরং সড়ক অবরোধ, গণসংগীত, পোস্টারিং এবং কবিতার মাধ্যমে আন্দোলনকে এক নতুন সাংস্কৃতিক রূপ দেয়। রাজপথে তখন শ্লোগান ছিল— ‘কোটা না মেধা-মেধা মেধা’; ‘সারা বাংলায় খবর দে, কোটা প্রথার কবর দে;’ ‘আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই;’, ‘আপস না সংগ্রাম-সংগ্রাম সংগ্রাম;’ ‘দালালি না রাজপথ-রাজপথ রাজপথ;’


১৪ জুলাই ২০২৪, তৎকালীন স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার এক বক্তব্যে কোটা আন্দোলনকারীদের  রাজাকারের নাতি-পুতি” হিসেবে অভিহিত করেন। এই বক্তব্যের প্রতিবাদে ওই দিন মধ্যরাতে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ শুরু হয়। মধ্যরাতে আন্দোলনে নামেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ (ঢাবি) আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এ সময় আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর উক্তিকে ঘিরে ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার। কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার” স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে ক্যাম্পাস।

১৫ জুলাই থেকে শুরু হয় দমন-পীড়নের ভয়াবহ ধাপ। দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতৃত্বে শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকারীদের উপর রড, লাঠি,হকি স্টিক, রামদা, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা করা হয়। একই সাথে পুলিশও লাঠি, রাবার বুলেট দিয়ে হামলা করে।

এর ঠিক পরদিন—১৬ জুলাই ২০২৪থেকে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। এদিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হলে আন্দোলন স্ফুলিঙ্গের মত পুরো দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে। আবু সাইদের মৃত্যুকেই আন্দোলনে মোড় ঘোরানো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে গণ্য হয়। আবু সাইদ শুধু একজন প্রতিবাদকারী ছিলেন না—তিনি ছিলেন নতুন প্রজন্মের স্বপ্ন, সাহস আর আদর্শের প্রতীক। তার রক্তে রাজপথ লাল হয়ে ওঠে, আর আন্দোলন আরও বিস্ফোরক রূপ নেয়। 

১৭–২০ জুলাই দেশের পরিস্থিতি চরম উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ১৮ জুলাই ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঢাকায় কার্যত কারফিউ জারি করা হয়, রাস্তায় সেনাবাহিনী নামানো হয়। সাংবাদিকদের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়। কিন্তু, ভয় পায়নি কেউ—বরং ছাত্রদের প্রতিবাদ আরও জোরালো হয়। সাধারণ মানুষ, শিক্ষক, অভিভাবকরাও আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করতে শুরু করেন।

২১ জুলাই বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করে ও সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে ৯৩ শতাংশ নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করে। ২২ জুলাই এই বিষয়ে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে কিন্তু ততদিনে বেশ দেরি হয়ে গেছে, দমন-পীড়নে শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন, আহতের সংখ্যা

গুণতির বাইরে। একদিকে দেশের অর্থনীতির করুণ অবস্থা, দুর্নীতি, দূর্বল শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আগে 

থেকেই সাধারণ মানুষের মাঝে ক্ষোভ ছিল। তারপর কোটা সংস্কার আন্দোলনে, দমন-পীড়ন দেখে দেশের

মানুষের পক্ষে আর স্বৈরাচার আওমীলীগ সরকারকে সহ্য করা সম্ভব ছিল না। ১৫ বছরের জমে থাকা 

ক্ষোভ একবারে উগ্রে দিতে শুরু করে জনসাধারণ।কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়ে উঠে দেশের সর্বস্তরের মানুষের স্বৈরাচার পতনের 

"অসহযোগ আন্দোলন"। মিছিলে শুরু যুক্ত হয় নতুন স্লোগান - ‘এক, দুই, তিন, চার, শেখ হাসিনা গদি ছাড়;’ ‘কলম ছেড়ে লাঠি ধর, স্বৈরাচার বিদায় কর।’, 'আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাহিরে;’ ‘আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না;’ ‘তোর কোটা তুই নে, আমার ভাইরে ফিরায়া দে;’ ‘লাশের ভেতর জীবন দে, নইলে গদি ছাইড়া দে;’ ‘এক দফা এক দাবি শেখ হাসিনা কবে যাবি;’ ‘দফা এক দাবি এক, খুনি হাসিনার পদত্যাগ;’ 

এই স্লোগান গুলোই যেন পুরো গল্পটা বলে দেয়। 


 

অবশেষে আসে ৫ আগস্ট।
টানা এক মাসের রক্তক্ষয়ী আন্দোলন, হাজারো তরুণের ত্যাগ, রাজপথে রাতজাগা প্রতিরোধের পর ভেঙে পড়ে ক্ষমতার মঞ্চ। দুপুরে খুনি শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করে এবং হেলিকপ্টার যোগে পালিয়ে যায়। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে কোনো ঘোষণাও আসে না—গণভবন ও সংসদ ভবনের দখল নেয় জনতা। সেনাবাহিনী দায়িত্ব নেয় প্রশাসনিক নিরাপত্তার, এবং বিকেলের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তুতির ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
এটি ছিল এক স্বৈরাচারী অধ্যায়ের আনুষ্ঠানিক অবসান—যা ইতিহাস লিখে রাখে, প্রজন্ম মনে রাখে। বাংলাদেশ শুরু করে তার নতুন পথচলা। 


উপসংহার

২০২৪ সালের জুলাই, বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় এক লাল দাগ—যেখানে রাজপথে দাঁড়িয়ে হাজারো তরুণ বলেছিল, "এবার যথেষ্ট!"
তারা কেবল চাকরি চায়নি, তারা চেয়েছিল মর্যাদা, ন্যায্যতা, ও সুযোগের সমতা।
এই ছিল ‘জুলাই বিপ্লব’—একটি প্রজন্মের জেগে ওঠা, যেখানে পোস্টার, মিছিল, গান, আর রক্ত একসাথে গল্প বলে।

এ আন্দোলন নিছক কোটা সংস্কার বা সরকার পতনের আন্দোলন নয়।
এটি ছিল রাষ্ট্র কাঠামোর অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক সম্মিলিত প্রতিবাদ।
যেখানে রাজপথে পড়েছিল আবু সাইদের রক্ত, সেখানেই দাঁড়িয়েছিল হাজারো নতুন আবু সাইদ, যারা ভয় পায় না—কারণ তাদের কণ্ঠে ছিল সত্য।

৫ আগস্ট ছিল পরিসমাপ্তি, কিন্তু সেটাই শেষ নয়।
সেটাই ছিল একটা নতুন বাংলাদেশের শুরুর দিন,
যেখানে তরুণরা রাজনীতি চর্চা করে গুলিতে নয়, যুক্তিতে।

এই বিপ্লব প্রমাণ করে—প্রতিটি প্রজন্মের একটা সময় আসে,
যখন তারা শুধু ইতিহাস পড়েনা, ইতিহাস লিখে

ভয় নয়, এবার কথা বলার সময়।

About the author

MD Zakaria Hossen
Hi! I am Zakaria. I am the founder of Kochu Programmer. I want to spread tech knowledge to everyone.

إرسال تعليق